কোয়েল পাখি পালনের লাভ লস - চিকিৎসা বিস্তারিত এবং খাদ্য তালিকা
সূচিপত্র: কোয়েল পাখি পালনের পদ্ধতি ও চিকিৎসা খাদ্য নিয়ে বিস্তারিত ,
কোয়েল পাখি পালনের লাভ লস - চিকিৎসা বিস্তারিত এবং খাদ্য তালিকা
বর্তমান বিশ্বে বেকারত্ব দূর করতে কোয়েল পাখি পালনের কোন বিকল্প নেই। যুবকদের বেকারত্ব দূর করতে কোয়েল পাখি পালন অন্যতম একটি উপায়। কোয়েল পাখি পালনের ক্ষেত্রে সকল নিয়ম জেনে তারপর পালন করলে লাভবান হওয়া সম্ভব। সুতরাং প্রত্যেকেরই উচিত আগে কোয়েল পাখি পালন সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা। পাখি পালনে লাভবান হওয়ার মূল বিষয় গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো :
স্বল্প খরচে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব কোয়েল পাখি পালনের মাধ্যমে। মাত্র ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচে পাখি পালনের মাধ্যমে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। তবে পালন পদ্ধতি সঠিক না হলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
সর্বপ্রথম জাপানে কোয়েল পাখি পালনের সূচনা হয় এরপর ধীরে ধীরে এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। লোকমুখে শোনা যায় কোয়েল পাখির কোনো রোগ হয় না, এটি সাধারণ ভাবে পালন করলেই লাভবান হওয়া যায়। কিন্তু এ মন্তব্যগুলো সম্পূর্ণ ভূল।
- রোগ:আসিরিটিভ এনটিরিটিস বা কোয়েল ডিজিজ এসকল রোগের কারণে কোয়েল পাখি মারা যায়। তাই আমাদের সবসময় কোয়েল পাখিকে সাবধান পালন করতে হবে ও এই সকল রোগ থেকে দূরে রাখতে হবে।
- খাবার:যেকোনো সাধারণ খাবার দিয়ে কোয়েল পাখির বাচ্চা বাঁচানো সম্ভব নয়। বিশেষ করে ব্লিডিং করে ফোটানো বাচ্চার ক্ষেত্রে তো একেবারেই না। বাচ্চার বয়স ও অবস্থা বিবেচনা করে ওদের খাবার ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তবেই শুধু কোয়েল পাখি পালন করবে লাভবান হওয়া যাবে।
- চিকিৎসা: কোয়েল পাখির যেকোনো রোগের চিকিৎসার জন্য আগে রোগ নির্ণয় জরুরি। রোগ নির্ণয় করে তারপর যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে খাবার ব্যবস্থা পরিবর্তন করলে রোগের সংক্রমণ কমানো সম্ভব।
- বাজারে ব্যবস্থা: কোয়েল পাখি থেকে লাভবান হওয়ার জন্য আমাদের বাজার ব্যবস্থার বিশেষ ধারণা থাকা উচিত। কেননা আমরা যদি ভুল সময়ে এবং ভুল দামের পাখি বিক্রি করি এবং পাখির ডিম বিক্রি করি। তবে সেটি আমাদের জন্য লস ও ক্ষতিকর হয়ে উঠবে।
- স্থান নির্বাচন: আমরা যদি একটি দূষিত স্থানে কোয়েল পাখির খামার কিংবা ফার্ম তৈরি করি। তো হবে সেখানে থেকে আমরা লাভবান হতে পারব না। যে কারণে আমাদের একটি ভালো ও সুস্থ পরিবেশে কোয়েল পাখির খামার তৈরি করতে হবে।
কোয়েল পাখি লালন পালন পদ্ধতি
কোয়েল পাখি পালনের পূর্বে প্রথমে জায়গা নির্ধারণ করতে হবে এবং পাখির বাচ্চা অনুযায়ী খামার বা খাঁচা তৈরি করতে হবে। এরপর কোয়েল পাখি পালনের জন্য বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। আপনি যদি নতুন উদ্যোক্তা হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই ২৫০-৫০০ বাচ্চা খামারে তুলে প্রথম পর্যায়ে পালন করে নিশ্চিত হবেন এর ধরন সম্পর্কে।
এরপর সঠিক নিয়ম অনুসরণ করে বেশি বাচ্চা খামারে তুলতে হবে। কোয়েল পাখি পালনের ক্ষেত্রে রোগ থেকে কোয়েল পাখি খেয়ে দূরে রাখা সব থেকে উত্তম। কেননা কোয়েল পাখির রোগ অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
আপনি যদি শীতের সময় কোয়েল পাখি পালন করে থাকেন। তবে ঠান্ডা থেকে কোয়েল পাখিকে দূরে রাখুন, সবসময় গরম রাখার চেষ্টা করুন।
খাচায় কোয়েল পাখি পালন পদ্ধতি
খাঁচায় কোয়েল পাখি পালনের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। নয়তো যদি একটি খাচায় বেশি পরিমাণে আবার অন্য একটি খাঁচায় কম পরিমাণে পাখি রেখে দেন। তবে এ কারণে সমস্যা হতে পারে যে জন্য আপনি ১ বর্গফুটে ৮ টি করে কোয়েল পাখি রাখা সম্ভব। এর থেকে বেশি হয়ে গেলে রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এবং আরো যে পদ্ধতি মেনে কোয়েল পাখি জন্য খাঁচা তৈরি করবেন তা হল:
- কোয়েল পাখি যেহেতু খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছোট পাখি তাই এদের ছোটাছুটির জন্য নির্দিষ্ট জায়গা বানাতে হবে। এতে করে কোয়েল পাখির স্বাস্থ্য ও মেজাজ ভালো থাকবে যে কারণে তাদের দৈহিক বৃদ্ধি হবে।
- পাখির খাঁচায়/ খামারে ধানের তুষ বা কাঠের গুঁড়া ছড়িয়ে রাখতে হবে। যাতে বিষ্ঠাগুলোর জন্য জেজা পরিবেশ না হয়। এবং পরিবেশের গরম রাখতে সাহায্য করেছে এ কারণে কাঠের গুড়া বা তুষ দেওয়া জরুরী।
- খাঁচায় / খামারে লাইটিং পদ্ধতি রাখা যাতে পাখির চারপাশে আবহাওয়া উষ্ণ এবং সতেজ থাকে। খামারে বাতাস প্রবেশের জন্য ছিদ্র যুক্ত জাল ব্যবহার করা অথবা অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি। এতে পাখিগুলো বেশি চঞ্চল এবং সুস্থ থাকবে।
আশা করা যায় এই সকল পদ্ধতি মেনে যদি আপনি খাচা তৈরি করেন। তবে অবশ্যই আপনার কোয়েল পাখি সুস্থ থাকবে তাই এ সকল নিয়ম মেনে খাঁচা তৈরি করার চেষ্টা করবেন।
কোয়েল পাখি রোগ ও চিকিৎসা
লোকমুখে শোনা যায় কোয়েল পাখির কোনো রোগ নেই এবং এগুলোর জন্য তেমন কোন চিকিৎসা পদ্ধতি বা সতর্কতার প্রয়োজন নেই, কিন্তু এ ধারণাটি একেবারেই অযৌক্তিক। কারন পশুপাখি পালন করতে গেলে এদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সবসময়ই থাকে।
এজন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। কোয়েল পাখি পালনের একটি ভালো দিক হলো হাঁস ,মুরগি অথবা পোল্ট্রি মুরগির তুলনায় এগুলোর রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।কোয়েল পাকে যে সকল রোগ অনেক বেশি দেখা দেয় তা হল:
- মাইকোপ্লাজমা।
- অপুষ্টি: খাবারের মান ভালো করতে হবে এবং একই ধরনের খাবার পাখিকে খাওয়াতে হবে তবে পাখির পুষ্টি হবে।
- ক্ষত সৃষ্টি:এই রোগ হলে এই ওষুধগুলো খাওয়ানো উচিত(Bacitracin,Streptomycin,Chloromycetin, Tetracycline, furazolidone, Amoxycillin)।
- কলিসেপ্টিসেমিয়া: এই রোগে আক্রমণ হলে তিন দিন পর্যন্ত ১০ কেজি থেকে পাঁচ কেজি খাবারের মধ্যে ৫০০গ্রাম এর টেট্রাসাইক্লিন খাওয়াতে হবে।
- রক্ত আমাশয়: কোয়েল পাখির যদি রক্ত আমাশায় হয় তবে প্রত্যেক ৫০ বস্তায় খাদ্যের মধ্যে ৬২ গ্রাম অ্যাম্প্রোলিয়াম (Amproluum) খাওয়াতে হবে।
- স্পর্শজনিত চর্মপ্রদাহ।
- মারেক্স রোগ: এই রোগের এখন পর্যন্ত কোন টিকা বের হয়নি যে কারণে এই রোগটি হলে পাখির অনেক যত্ন নিতে হয়।
- লিম্ফয়েড লিউকোসিস: এখন পর্যন্ত এই রোগের কোন ওষুধ ও ফর্মুলা তৈরি হয়নি যে কারণে এই রোগ হলে সেই পাখিটিকে সব পাখি থেকে আলাদা করে রাখা উচিত।
- কৃমির আক্রমণ: আমাদের যে পাখির পায়খানা রয়েছে সেগুলো পরিষ্কার করে রাখতে হবে। সেখানে পাখি এবং কিসমিস রোগ হলে থায়াবেনডাজল খাওয়ানো যেতে পারে।
- ঠুকরা-ঠুকরি বা ক্যানিবালিজম: প্রথমে ঠকরা টুকরি কি কারণে করছে সেই কারণে বের করে সমাধান করতে হবে। এবং পাখির ঠোট কেটে বা ফাটিয়ে দিতে হবে।
- ডিম আটকে যাওয়া: পেটের মধ্যে অতিরিক্ত চর্বি জমে যাওয়ার জন্য এই রোগ দেখা দেয়। যে কারণে যে খাবারে চর্বি রয়েছে অতিরিক্ত এমন ধরনের খাবার না খাওয়ানো উচিত।
এসকল রোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভাইরাস আক্রমণ। পাখির অসুস্থ হয়েছে কিনা তা বোঝার বিভিন্ন লক্ষন রয়েছে। যেমন ঝিমঝিম ভাব, ঠিক মতো খাবার না খাওয়া, হাঁচি -কাশি, ডানা ঝুলে পড়া,চোখ লাল হয়ে যাওয়া, বিষ্ঠার সাথে রক্ত আসা, ঠিকমতো ডিম দিতে না পারা, লোমের গোড়ায় গুটি ওঠা ইত্যাদি।
ভাইরাস আক্রমণ হলে দ্রুত চিকিৎসা না করালে একসাথে খাঁচার প্রায় সব পাখি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই রোগ নির্ণয়ের পর তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। পাখিগুলোকে সুস্থ রাখতে জন্মের পর খাবারের সাথে ভিটামিন মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। এতে রোগের ঝুঁকি কমে যাবে আর বাচ্চা মারাও যাবে না।
কোয়েল পাখি কত দিনে ডিম পারে
আমাদের সকলের জন্যই একটি কমন প্রশ্ন একটি কোয়েল পাখি ঠিক কতদিন বয়স হলে ডিম দিতে শুরু করবে এবং কতদিন পর্যন্ত ডিম দিবে। উত্তর হলো - একটি পরিপূর্ণ সুস্থ মেয়ে কোয়েল পাখি সাধারণত ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে ডিম দিতে শুরু করে। তবে অপুষ্টিজনিত রোগ থাকলে পাখির ডিম পারতে ৫০-৫৫ দিন অথবা এর থেকে বেশি সময়ও লেগে যায়।
তাই পাখির সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে। পাখি গুলোর সুস্থতা নিশ্চিত করলে ৬ থেকে ৭ সপ্তাহেই ডিম পাড়তে শুরু করে দিবে। ডিম পারা শুরু করলে প্রতিদিন একটি করে ডিম দিতে সক্ষম হয় পাখিগুলো। ১২ সপ্তাহ বয়স হওয়ার পর ডিম পারা আস্তে আস্তে কমে যায়। জাপানি জাতের কোয়েল পাখি ৩-৩.৫ বছর বয়স পর্যন্ত ডিম দিতে থাকে।
আর দুবাই জাতের কোয়েল পাখি ২-৩ বছর পর্যন্ত ডিম দেয়। সুস্থ একটি কোয়েল পাখি বছরে ২৪০-২৭০ টি করে ডিম দিতে পারে।
যেজাতের কোয়েল পাখি বেশি ডিম দেয়
আমাদের দেশের যুবকরা কোয়েল পাখি পালন করে মূলত দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে, একটি হলো ডিম বিক্রি এবং অপরটি হলো পাখির মাংস বিক্রির জন্য। বাংলাদেশে জাপানি জাতের কোয়েল পাখি বেশি জনপ্রিয়। এটি ৪০-৪৫ দিন বয়স থেকেই ডিম দিতে শুরু করে এবং ৩-৩.৫ বছর পর্যন্ত ডিম দিতে থাকে। সাধারণত জাপানি জাতের একটি কোয়েল পাখি ২৫০ গ্রাম থেকে ৩০০ গ্রামের হয়ে থাকে। তবে এরা বছরে অনেক ডিম দিতে সক্ষম। তাই বেশি ডিম উৎপাদনের জন্য জাপানি জাতের কোয়েল পাখি বেশি ভালো।
কোয়েল পাখির প্রথম দিন থেকে ঔষধ তালিকা
আরো পড়ুন: কোয়েল পাখির সপ্তাহিক ওষুধ তালিকা
তবে প্রাপ্ত বয়স্ক কোয়েল পাখির চর্ম জনিত রোগ বেশি হয়ে থাকে। ঠোকরা - ঠুকরির কারনে ঘা হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে এমন না হয় । সিজন অনুযায়ী ঔষধ খাওয়াতে হবে। যেমন - শীতকালে ঠাণ্ডা কাশির জন্য বিশেষ ভিটামিন বা ঔষধ আবার গরমকালে অন্য ঔষধ।
কোয়েল পাখিকে যেসব ফিট খাওয়ানো যায় ও ফিডের দাম
হাঁস, মুরগি অথবা পোল্ট্রি মুরগির তুলনায় কোয়েল পাখির খাদ্য তালিকা খুবই সাদামাটা। স্বাভাবিক ভাবেই একটি কোয়েল পাখি সারাদিনে ২০-২৫ গ্রাম খাবার গ্রহণ করে থাকে। কোয়েল পাখিকে ফিড খাওয়ানো যায়। এবং বাজারে আলাদা আলাদা ধরনের ফিড রয়েছে। কোয়েল পাখির খাদ্য তালিকা তে বিভিন্ন ধরনের খাবার রয়েছে ।
যেমন- ভুট্টা ভাঙ্গা, গমের ভূসি বা গম ভাঙ্গা, তিলের খৈল, ধানের তুষ বা ভূষি, ঝিনুকের গুড়া, শুঁটকির গুড়া ইত্যাদি। শুধুমাত্র যেকোনো একটি খাবার প্রতিদিন খাওয়াতে হবে এমনটি নয়। প্রত্যেকটি খাবার পরিমাণ মতো আলাদা আলাদা ভাবে খাওয়াতে হবে। খাবারের গুণগত মান ঠিক থাকলে পাখির হজমে সুবিধা হয় এবং পুষ্টিগত দিক দিয়ে দ্রুত বৃদ্ধি হয়।
আমাদের পরামর্শ
কোয়েল পাখি পালন করে লাভবান হওয়ার জন্য আমাদের কোয়েল পাখির অনেক ভালো হবে যত্ন ও খেয়াল রাখতে হবে। যদি কোয়েল পাখির কোন অসুখ হয় তবে অবশ্যই একটি ভাল ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তার চিকিৎসা করতে হবে। এবং ডাক্তার দেখিয়ে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ও চিকিৎসা করা উত্তম।
আমরা যথাযথভাবে কোয়েল পাখির পালনের বিষয়টি আপনাদের জানার চেষ্টা করেছি। তবে কোন বিষয় যদি বুঝতে না পারেন তবে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। এবং কোয়েল পাখির লাভবান হওয়ার উপায় গুলো মেনে চলেন।
সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন।
নতুন কোয়েল খামারিরা এটা পড়লে অনেক উপক্রিত হবে।